জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার (১৭ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১–এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই রায় দেন।
প্যানেলের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আদালতে রায় ঘোষণার সময় পুরো প্রক্রিয়াটি গুরুত্ব ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরিচালিত হয়।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যকে উসকানিমূলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তদন্ত ও বিচারে আরও উঠে আসে যে আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগে বলা হয়, এসব নির্দেশের ফলে বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হয়। বিশেষ করে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় আরও ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে মামলার মূল অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তদন্ত সংস্থা এসব ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকার ওপর আলোকপাত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করে।
মামলার শুরুতে শুধুমাত্র শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। কিন্তু তদন্ত অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন তথ্য-প্রমাণ সামনে আসে। গত ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে মামলায় নতুন আসামি হিসেবে যুক্ত করা হয়। পরে গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নামও উঠে আসে। দীর্ঘ তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর গত ১০ জুলাই ট্রাইব্যুনাল আনুষ্ঠানিকভাবে তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। একই দিনে সাবেক আইজিপি মামুন আদালতে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন জানান এবং পরে তিনি আদালতে বিস্তারিত জবানবন্দি দেন, যা মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেয় বলে আদালত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে।
প্রেক্ষাপট হিসেবে উল্লেখযোগ্য যে, গত বছরের জুলাই-আগস্টজুড়ে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার টানা আন্দোলনে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছায়। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। তার সঙ্গে দেশ ছাড়েন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও। ফলে মামলার তিন আসামির মধ্যে গ্রেফতার আছেন কেবল সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন; অন্য দুজন পলাতক।
পলাতকদের আপিলের সুযোগ বিষয়ে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার সাংবাদিকদের জানান, ট্রাইব্যুনাল আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হলেও আসামিকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। পলাতক অবস্থায় কেউ আপিলের সুযোগ পান না। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলে সে অবস্থাতেও আসামি আপিল করতে পারেন। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের আপিলের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
আদালতের রায় ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ সংশ্লিষ্ট এ মামলার গুরুত্ব ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবস্থান- সব মিলিয়ে এটি দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় যোগ করেছে।

আপনার মতামত লিখুন :