সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে অনেক প্রভাবশালী নেতারা বিভিন্ন সময়ে নতুন দল তৈরি করেছেন। বর্তমানে জাতীয় পার্টির নামে ছয়টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে এরশাদের জাতীয় পার্টির পাশাপাশি, জাতীয় পার্টি (রওশর এরশাদ) জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও জাতীয় পার্টির (মতিন) নেতারা একমঞ্চে এসে আবারও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি গড়ার ঘোষণা দিলেন।
এরশাদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে সোমবার (১৪ জুলাই) দুপুরে গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় পল্লীবন্ধু এরশাদ স্মৃতি সংসদ আয়োজিত স্মরণসভায় তারা এ ঘোষণা দেন। মূলত জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যার এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পল্লীবন্ধু এরশাদ স্মৃতি সংসদ ব্যানারে এ স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়।
জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, জাতীয় পার্টি (রওশন এরশাদ) নির্বাহী সভাপতি কাজী ফিরোজ রশীদ, সাবেক এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, জনতা পার্টি বাংলাদেশের (জেপিবি) প্রধান উপদেষ্টা সাবেক এমপি শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন, জাতীয় পার্টির (মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয়, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য দিদারুল আলম চৌধুরী। জাপার সাবেক সংসদ সদস্য নাজমা আক্তার, অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা ও অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন, জাপার ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা, খুলনা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা আল মাহমুদ, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, জহিরুল ইসলাম জহির, জসিম উদ্দিন ভুঁইয়া।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, আমাকে বলা হয় আমি জাতীয় পার্টি ভেঙেছি। কিন্তু আমি দল ভাঙিনি। দল আমাকে বের করে দিয়েছে। আমার নেতৃত্বে আন্দোলন করে আমি এরশাদকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছিলাম। আমি সব সময় বলে এসেছি ঐক্যের কথা। আজ এরশাদ সাহেবের স্মরণ সভায় এসে বৃহত্তর ঐক্যের যে কথা শুনছি, তা যদি বাস্তবে কার্যকর করা যায়, তাহলে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হবে।
তিনি বলেন, এরশাদকে স্বৈরাচার বলা হতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচার বলা হচ্ছে। সময়ের পরির্বতনে আরও অনেক দলকে স্বৈরাচার বলা হবে। এই নেতা আরও বলেন, সব সরকারই সংস্কার করতে চায়, একই সঙ্গে সব সরকার ভালো কাজ করতে চায়। কিন্তু নানা বাধার কারণে সব কিছু করা যায় না। এরশাদ সাহেব যে সংস্কার করে গেছেন; তা কোনো সরকার করতে পারেনি।
স্মরণ সভায় ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা যে জন্য জীবন দিয়েছেন, সে স্বপ্ন এখানো পূরণ হয়নি। দেশে আজ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি। সাধারণ মানুষ চরমভাবে নিরাপত্তহীনতা মধ্যে রয়েছে। দেশের এ অস্তির সময়ে দেশ ও দেশের মানুষের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে।
তিনি বলেন, শেষ জীবনে আমাদের উচিত দেশকে কিছু দেওয়া। তাই আমরা যারা আজ এখানে এক মঞ্চে উপস্থিত হয়েছি, আমাদের উচিত হবে সবাই মিলে জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে কাজ করা। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে জাতীয় পার্টি হবে জাতীয় রাজনীতির বিকল্প শক্তি।
ব্যরিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আমরা অবশ্যই নির্বাচন চাই। তবে তার আগে দেশের স্থিতিশীল পরিবেশ চাই। তিনি বলেন, আজ সরকার যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে, সে সংস্কার এরশাদ সাহেব ৩৫ বছর আগে শুরু করে গেছেন। রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আসুন আমরা শেষ জীবনে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করি। দেশে আবারও পরিবর্তন আসবে। আমরা দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে যাব।
তিনি বলেন, এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময় বিচার ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, যশোর ও কুমিল্লায় ৬টি হাইকোর্টের বেঞ্চ সম্প্রসারণ করেন। এছাড়া বিচার ব্যবস্থাকে আরও বেগবান করতে প্রতিটি উপজলোয় মুনসেফ কোর্ট স্থাপন করেন তিনি। ৩৫ বছর পর এসে আজকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুগান্তকারী সেই কাজটি করার জন্য আবারও উদ্যোগ নিয়েছে।
হাওলাদার বলেন, সব রাজনৈতিক দলের তীব্র বিরোধিতা উপক্ষো করে ১৯৮৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রেরণ করেন। কিন্তু ৩৭ বছর পর আজ এসে প্রমাণিত হয়েছে ১৯৮৮ সালের ১৬ আগস্ট জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শান্তিরক্ষী প্রেরণ ছিল যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক এবং দূরদর্শী রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। বিগত ৩৭ বছরে বিশ্বের প্রায় ৪৩ দেশে প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজারের বেশি শান্তিরক্ষী বিচক্ষণতা, পেশাদারিত্ব দিয়ে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে একটি সুন্দর ও বসবাস-উপযোগী সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবদান আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থাানের পর দেশের পারিবারিক রাজনৈতিক কবর রচনা হয়েছে। এখন স্বামী-স্ত্রীর কথায় রাজনৈতিক দল পারিচালিত হবে না। এখন রাজনীতিক দল পরিচালিত হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে-যৌথ নেতৃত্বে মাধ্যমে।
তিনি বলেন, আমি প্রয়োজনে মহাসচিব থাকব না। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে অনুরোধ করব; তারা যেন আমাদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগায়। চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের উদ্দেশ্যে শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, সব বিভেদের অবসান ঘটিয়ে দলকে যদি ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন, তবেই দল আগামী দিনে ভালো ফলাফল প্রত্যাশা করতে পারে। আপনি বিভেদ ভুলে যান। ঐক্যের প্রক্রিয়ায় সামিল হন।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, মহান আল্লাহর নাম নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি গড়ে তুলব। যৌথ নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাব। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে, ১৮ কোটি মানুষের স্বার্থে আমরা জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করব৷ আজকে থেকে আল্লাহর নামে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে চলব। কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নাই।
শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর বলেন, আওয়ামী লীগ আর ফিরতে পারবে কিনা, তা আমরা জানি না৷ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে বিএনপির জনপ্রিয়তাও নিচের দিকে। আজকে দেশের মানুষ বিএনপি, আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টিকে দেখতে চায়। এ সময় তিনি জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা যদি এক হন, যদি বিকল্প শক্তি হিসেবে দলকে দাঁড় করাতে পারেন, তবে আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।
একই কথা বলেন দলটির নির্বাহী চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন। তিনি বলেন, জনতা পার্টি বাংলাদেশ যদি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনও পেয়ে যায় তবেও আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, আগামী দিনে জাতীয় পার্টিকে আমরা সবাই মিলে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলব।
জাফর আহমেদ জয় বলেন, মানুষ বলে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা চার পাঁচটা ভাগে ভাগ হয়ে নিজেরা নিজেদের সর্বনাশ করেছে। তাদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবোঝির হয়েছে, তা সমাধান করা সম্ভব। কারণ, তাদের মধ্যে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। তাই আজকে জাপাকে একতাবদ্ধ করতে আমাদের মুরুব্বি বলছি, দলকে একতাবদ্ধ করতে আপনাদের আজ থেকেই চাপে রাখব।
আপনার মতামত লিখুন :