সীমানা লঙ্ঘন করে বান্দরবানের রেমাক্রি মুখ এলাকায় আরাকান আর্মির জলকেলি উৎসব পালন নিয়ে পাহাড়ের শান্তিকামী মানুষের মাঝে চলছে সমালোচনার ঝড়। উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশের সার্বভৌমত্ব কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দারা। স্থানীয় উপজাতীয় নেতাদের সরাসরি সহযোগিতায় আরাকান আর্মির সদস্যরা পাহাড়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
স্থানীয়দের অভিমত, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এখানকার পাহাড়ের বিভিন্ন উৎসবে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার মাধ্যমে তারা নিজেদের আদর্শিক প্রভাব বাড়াতে চাইছে। পাহাড়ির আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে সখ্য গড়ে তুলে সমর্থন আদায়েরও চেষ্টা করছে।
মিয়ানমারে হত্যাযজ্ঞ এবং রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-নিপীড়ন করে নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করার উদাহরণ দিয়ে আলাদা প্রদেশ গঠনে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোকে সে পথে হাঁটার পরামর্শও দিচ্ছে আরাকান আর্মি।
এদিকে ঘটনার পেছনে গভীর ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে আরাকান আর্মির প্রবেশ বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে পাহাড়ের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং চরমপন্থী সংগঠনের উদ্ভব ঘটবে আগের চেয়ে বেশি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার (অব.) রোকন উদ্দিন বলেন, বান্দরবান সীমান্তের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মির উপস্থিতির বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা ভুল হবে। এ উৎসবকে ব্যবহার করে তারা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাথে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক সম্পর্ক ঘনীভূত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
তিনি আরও বলেন, এ আয়োজনে স্থানীয় উপজাতীয় নেতাদের সরাসরি সহযোগিতা রয়েছে। তারা সহযোগিতা না করলে কোনোভাবেই এখানে তারা আসতে পারত না। শুনেছি জলকেলি উৎসবে আরাকান আর্মির সদস্যরা জাতিগত পতাকা, আরাকানের প্রতিরোধমূলক গান, প্রতীকী ভাষা ও ইঙ্গিত ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিজেদের অঙ্গরাজ্য ভাবতে শুরু করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৭ এপ্রিল বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার ১ নম্বর রেমাক্রি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রেমাক্রি বাজারের সামনে সাঙ্গু নদীর চরে ‘মাহা সাংগ্রাই পোয়ে-২০২৫’ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে প্রায় ১০ কিমি. অভ্যন্তরে এই জায়গার অবস্থান। এতে ছিল মৈত্রী পানি বর্ষণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এই অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের দেখা যায়। তাদের ভেতর ছিলেন ইউএলএ কমান্ডার লাভ্রের (স্থানীয় নাম কুখাই রাখাইন), কক্সবাজার থেকে আগত ইউএলএ লিডার মংথুইহ্লা মারমা, আরাকানের সক্রিয় সদস্য লেফটেন্যান্ট জোকা, আরাকান আর্মির সক্রিয় সদস্য ক্যাপ্টেন ক্যজো রাখাইন এবং ক্যাপ্টেন ভোলং। তাদের সাথে আরও ছিলেন দলের অস্ত্রধারী সদস্যরাও।
পুরো আয়োজনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ছবি এবং ভিডিও পরবর্তীতে আরাকান আর্মি তাদের অফিশিয়াল ফেসবুকে আপলোড করে। এর পরপরই এই ঘটনা নিয়ে বিজিবির সদস্যদের নির্বিকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
কেবল তাই নয়, এই আয়োজনে আরও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় উপজাতি নেতারাও। এদের ভেতর রয়েছেন—থানচি উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য খামলাই ম্রো, ১ নম্বর রেমাক্রি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুইশৈইথুই মারমা রনি, ২ নম্বর তিন্দু ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মংপ্রু মারমা, জেএসএস যুব সমিতির সভাপতি ও মারমা প্রতিনিধি নুমংপ্রু মারমা, রেমাক্রি ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার হ্লা থোয়াই প্রু।
অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থাকা লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং স্থানীয় প্রশাসন আরাকান আর্মির সদস্যদের চিহিৃত করার পরও নিষ্ক্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন। কেবল তাই নয়, আয়োজকেরা এই উৎসব পালন করার পেছনে আরাকান আর্মির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ কাওছার বলেন, ঘটনা সত্যি। তবে জায়গাটি দুর্গম, তাই তথ্য উদঘাটনে একটু সময় লাগছে আমাদের। আরাকান আর্মির সদস্যরা অনেক আগ থেকেই সেখানে যাতায়াত করছেনে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :