এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জে ১১ হাজার ফল পরিবর্তন

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১ আগস্ট, ২০২৫, ১০:১৮ দুপুর

চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে ফেল করা তিন শিক্ষা বোর্ডের ২০ শিক্ষার্থী খাতা পুনর্নিরীক্ষণে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর মধ্যে মাদ্রাসা বোর্ডের ১৬ জন, তিন জন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এবং একজন ময়মনসিংহ বোর্ডের। এবার ১১ শিক্ষা বোর্ডে ১৩ হাজার ৯৭৯ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল দেখানো হয়েছিল এমন ৪ হাজার ৭৯২ জন পরীক্ষার্থী খাতা পুনর্নিরীক্ষণে পাশ করেছে। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে নতুন ১ হাজার ১৪৬ জন।

এতে প্রশ্ন উঠেছে পাবলিক পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নের ব্যবস্থাপনা নিয়ে। দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির মুখে পড়েছেন পরীক্ষকদের পাশাপাশি খাতা নিরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকরাও। একজন পরীক্ষক খাতা পরীক্ষার পর তা নিরীক্ষা করেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আরেকজন শিক্ষক। এরপর তা জমা দেওয়া হয় প্রধান পরীক্ষকের কাছে। তারও এটি নিরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। এভাবে কয়েক স্তরে পরীক্ষানিরীক্ষার পর ফল তৈরি করা হয়। কিন্তু এসবই যে দায়সারাভাবে চলছে তা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ব্যাপক ফল পরিবর্তনে। খাতা দেখা আর নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বিরাজমান এ ধরনের অবহেলার মাশুল দিচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী।

গতকাল রবিবার খাতা পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ৯টি সাধারণ এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের প্রকাশিত পুনর্নিরীক্ষণের ফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলেন, ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের অর্থ নতুন করে খাতা দেখে মূল্যান করা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। মূলত উত্তরপত্রের নম্বর যোগ ও বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কি না, তা দেখেই পুনর্নিরীক্ষণ শেষ করা হয়।

শিক্ষাবিদরা বলেন, নম্বর যোগ-বিয়োগের ভুলেই প্রতি বছর একেকটি পাবলিক পরীক্ষায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে পুনরায় খাতা দেখলে আবেদনকারীর বেশির ভাগেরই ফল পরিবর্তন হতো। পরীক্ষকদেরও আরও ভুল ধরা পড়ত। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদনে পুরো খাতা মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। শুধু নম্বর যোগে ভুল আছে কি না, খাতা থেকে নম্বর ঠিকমতো তোলা হয়েছে কি না, খাতায় সব উত্তরের পাশে নম্বর দেওয়া আছে কি না এবং ওএমআর শিটে ঠিকমতো বৃত্ত ভরাট হয়েছে কি না—এসব বিষয় দেখা হয়। বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, অনেক সময় একজন পরীক্ষার্থী ভালো নম্বর পেলেও তা বসাতে ভুল হতে পারে। খাতা যারা দেখেন তারাও মানুষ। তবে আমরা কেউই এ ধরনের ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল প্রত্যাশা করি না। এজন্য যেসব শিক্ষক খাতা দেখায় ভুল বা অবহেলা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন বেড়ে যাওয়ায় ও পরীক্ষকদের ভুল নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এ বিষয়ে গবেষণার জন্য বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটকে (বেডু) দায়িত্ব দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাদের গবেষণায়ও খাতা মূল্যায়নে ত্রুটিপূর্ণ হচ্ছে বলে প্রমাণ মেলে। তারা বলছে, ভুল উত্তরের জন্য নম্বর দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অনেক সময় সঠিক উত্তরের ক্ষেত্রেও নম্বর কম দেওয়া হচ্ছে। প্রধান পরীক্ষকদের খাতা ফের দেখে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সে কাজ ঠিকভাবে করেন না। এছাড়া স্কুল-কলেজের নামকরা শিক্ষকরা খাতা দেখেন না বলেও প্রমাণ পেয়েছে বেডু। জানা গেছে, অযোগ্য পরীক্ষক ঠেকাতে এর আগে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষকদের ডিজিটাল ডেটাবেজ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের গাইডলাইন ছাড়া তৈরি এই ডেটাবেজেও ঢুকে পড়ছেন অযোগ্য শিক্ষকরা। প্রতিষ্ঠানপ্রধান সম্মতি দিলেই একজন শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন পরীক্ষক। এতে জুনিয়র সেকশনের শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন মাধ্যমিকের পরীক্ষক, কলেজের শিক্ষকরাও মাধ্যমিকের পরীক্ষক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আবার কোনো শিক্ষক যদি স্বল্প সময়ের জন্যও কোনো একটি বিষয় পড়ান, তাহলেও তিনি ঐ বিষয়ে খাতা দেখার আবেদন করতে পারছেন। এক বিষয়ের শিক্ষক হয়েও অন্য বিষয়ের পরীক্ষক হওয়ার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। ডিজিটাল ডেটাবেজ করার সময় গাইডলাইন না দিলেও পরীক্ষক হওয়ার জন্য একটি নীতিমালা রয়েছে। এতে প্রধান পরীক্ষক হতে গেলে কমপক্ষে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। পরীক্ষক হওয়ার জন্য লাগে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। এছাড়া একজন শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফলও পরীক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনার কথা। তবে নীতিমালা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হয় না।

ঢাকা বোর্ডে প্রায় ৩ হাজার পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন :

এবার ঢাকা বোর্ডে ৯২ হাজার ৮৬৩ জন শিক্ষার্থী মোট ২ লাখ ২৩ হাজার ৬৬৪টি খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেন। তার মধ্যে ২ হাজার ৯৪৬ জনের ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে। ১০ জুলাই প্রথম প্রকাশিত ফলাফলে ফেল করেছিল এমন ২৯৩ জন পরীক্ষার্থী পাশ করেছে। রবিবার বেলা ১০টায় এ ফল প্রকাশ করা হয়। পরে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবিরের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে ফলাফলের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট ২৮৬ জন। বাকিদের ফলাফলে গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে। কেউ বি গ্রেড থেকে এ-মাইনাস, কেউ এ-মাইনাস থেকে এ গ্রেড পেয়েছেন।

দাখিল পুনর্নিরীক্ষণে ফেল থেকে পাশ ৯৯১ শিক্ষার্থী :

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ২০২৫ সালের দাখিল পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষণে ১ হাজার ৯১২ জন শিক্ষার্থীর ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে। পুনর্নিরীক্ষণে ফেল থেকে পাশ করেছেন ৯৯১ জন এবং ফেল থেকে ফেল অবস্থায় রয়েছেন ২৫৫ জন। গতকাল বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. কামরুল আহাসান এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, দাখিল পরীক্ষার পুনর্নিরীক্ষণের জন্য মোট ৩২ হাজার ৬০৫ জন শিক্ষার্থী ৬০ হাজার ৯০৩টি আবেদন করেছিলেন। ফল পরিবর্তনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯১২। এর মধ্যে ৩৯৮ জনের গ্রেড পয়েন্ট গড় (জিপিএ) পরিবর্তন হয়েছে। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৩৯ জন এবং জিপিএ-৫ থেকে জিপিএ-৫ এ রয়ে গেছেন ১২৯ জন।

বেশি ফেল শিক্ষার্থী পাশ করেছে কারিগরি বোর্ডে :

পুনর্নিরীক্ষণে ফল কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ফেল থেকে পাশ করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ৬৫৪ জন। যা অন্যান্য বোর্ড থেকে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসিতে ১২ জন পরীক্ষার্থী নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

Link copied!