সংবিধানের ওপর সনদের প্রাধান্য, সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া প্রস্তাবনা। এতে উল্লেখ রয়েছে আটটি অঙ্গীকারনামা ও ৮৪টি প্রস্তাবনা।
খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদের সুপারিশ ও প্রস্তাবনাগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এমনকি আলোচ্য সনদকে বিদ্যমান সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ আছে, জুলাই সনদের বৈধতা বা কর্তৃত্ব নিয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। পাশাপাশি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেসব প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কার্যকর করার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তবে খসড়া সনদের ১০টি প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল। নোট অব ডিসেন্টের মাধ্যমে তারা এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। আপত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে—প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না, এমন প্রস্তাব; বাছাই কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন; নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতির প্রস্তাব; উচ্চকক্ষে ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী রাখার প্রস্তাব; বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ার প্রস্তাব এবং ন্যায়পাল, সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক, দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব। এসব বিষয়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সংসদের ক্ষমতাকে অক্ষুণ্ণ রাখার পক্ষে মত দিয়েছে।
খসড়া সনদে বিদ্যমান সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভিত্তি হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি। পাশাপাশি নাগরিক পরিচয়ে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানে জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ এবং নাগরিক হিসেবে ‘বাংলাদেশি’ উল্লেখ থাকলেও খসড়ায় শুধুই ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
খসড়ায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অধীনে নিম্নকক্ষ হবে জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষে থাকবে ১০০ সদস্য। নিম্নকক্ষের সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকাও প্রকাশ করতে হবে। তালিকায় অন্তত ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী রাখার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও এনডিএম। তবে এ প্রস্তাবে সিপিবি দ্বিমত জানিয়েছে।
এছাড়া খসড়া সনদে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ধাপে ধাপে ১০০ আসনে উন্নীত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন নিয়োগ কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রকাশকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানও এতে যুক্ত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠন, দেশে ন্যায়পাল নিয়োগ, গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন এবং পুলিশ বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। পরে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা আলোচনা শেষে প্রস্তুত করা হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া প্রস্তাবনা, যা গতকাল দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে আগামী সপ্তাহে তৃতীয় দফা বৈঠক হবে। উল্লেখ্য, ১৫ সেপ্টেম্বর কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে।
আপনার মতামত লিখুন :